Apple Intelligence: টিম কুকের মতে সেরা, কী থাকছে এই নতুন প্রযুক্তিতে?
মেটা, অ্যালফাবেট, এবং অ্যামাজনের মতো জায়ান্টরা ইতিমধ্যেই নিজেদের এআই সেবা উন্মোচন করেছে। এর মাঝে কিছুটা ধীরগতিতে হলেও অ্যাপল এ দৌড়ে সামিল হয়েছে। সম্প্রতি, অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক জানিয়েছেন যে, অ্যাপল তাদের Apple Intelligence প্রযুক্তি আনতে ধীরে চললেও এটি হবে “সেরা”। এই কথার মাধ্যমে, তিনি অ্যাপলের এআই কৌশল এবং তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন। চলুন জেনে নিই, কী থাকছে অ্যাপলের এই নতুন প্রযুক্তিতে।
অ্যাপলের এআই (Apple Intelligence): টিম কুকের বক্তব্য
টিম কুকের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে এআই প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে যে, অ্যাপল তাদের এআই সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু সময় ধরে। যদিও চ্যাটজিপিটি এবং লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (LLM) মতো প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অ্যাপল তুলনামূলক ধীরগতিতে এগিয়েছে, তবে তাদের লক্ষ্য গতি নয় বরং কার্যকারিতা।
তিনি জানান, অ্যাপলের লক্ষ্য প্রথম হওয়া নয়, বরং সেরা হওয়া। এজন্য তারা প্রতিটি আপডেট এবং ফিচার এমনভাবে তৈরি করছে, যা ব্যবহারে সহজ এবং বাস্তবিকভাবে কার্যকর। কুকের মতে, “প্রযুক্তির উন্নয়ন কেবল সময়ের উপর নির্ভর করে না, বরং এর কার্যকারিতা এবং গ্রাহক সন্তুষ্টিই আসল মাপকাঠি।”
অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স (Apple Intelligence): নতুন ফিচারগুলো কী?
এ বছরের শুরুতে, অ্যাপল অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স (Apple Intelligence) নামে বেশ কিছু নতুন ফিচার উন্মোচন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ফিচার নিম্নরূপ:
- প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রদান: অন্যান্য এআই মডেল যেমন ওপেনএআই বা গুগল বাড যেখানে ওপেন ওয়েবে তথ্য অনুসন্ধান করে থাকে, অ্যাপলের এআই এ ক্ষেত্রে আলাদা। এটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের ভিত্তিতে তথ্য প্রদান করবে, অর্থাৎ ডিভাইসের ভিতরে থাকা তথ্য এবং ব্যবহারকারীর অভ্যাস অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক ফলাফল দেবে। এটি বিশেষ করে ব্যবহারের সময় বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।
- সিরি’র উন্নত সংস্করণ: অ্যাপলের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরি’কে নতুন করে আরও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন করা হয়েছে। আগের তুলনায় এটি আরও বেশি কার্যকর হবে, প্রশ্নের জবাব দিতে এবং কাজ সম্পন্ন করতে আরও স্মার্ট হয়ে উঠবে। ব্যবহারকারীদের সাথে আরও স্বাভাবিক এবং সঠিকভাবে কথা বলার ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই সিরি আপডেট করা হচ্ছে।
- ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নয়ন: অ্যাপলের এআই প্রযুক্তি বিশেষভাবে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে উন্নত করতে নকশা করা হয়েছে। প্রতিটি ফিচার এবং কার্যক্রম ব্যবহারকারীর ডেটা এবং অভ্যাসের উপর ভিত্তি করে কাস্টমাইজ করা হবে, যাতে তাদের প্রতিদিনের জীবন আরও সহজ এবং মসৃণ হয়।
অ্যাপল কীভাবে AI দৌড়ে পিছিয়ে?
অ্যাপল এআই প্রযুক্তির দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে, যা প্রধানত কয়েকটি কারণে ঘটেছে:
১. বিলম্বিত এআই পণ্য উন্মোচন:
অ্যাপল অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্ট যেমন মেটা, গুগল, এবং মাইক্রোসফটের মতো দ্রুতগতিতে এআই সেবা বাজারে আনতে পারেনি। যখন মাইক্রোসফট তাদের বিং সার্চে ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি সংযুক্ত করেছে এবং গুগল তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম, বার্ড চালু করেছে, তখন অ্যাপল মূলত এ ধরনের উদ্যোগ থেকে দূরে ছিল। এআই এবং মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করলেও, অ্যাপল এই ক্ষেত্রে তাদের পণ্যগুলো বাজারে আনতে ধীরে এগিয়েছে।
২. লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (LLM) অভাব:
চ্যাটজিপিটি এবং বার্ডের মতো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (LLM) দ্রুত বিস্তার এবং জনপ্রিয়তা অ্যাপলকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। অ্যাপল এখনো তাদের নিজস্ব শক্তিশালী ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল প্রকাশ করেনি, যা অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় তাদের পিছিয়ে রেখেছে। যদিও টিম কুক বলেছেন, গতি নয়, বরং কার্যকারিতা তাদের মূল লক্ষ্য, তবুও LLM-এর ক্ষেত্রে উন্নতমানের প্রযুক্তি আনতে অ্যাপলের সময় লেগেছে।
৩. গবেষণায় কেন্দ্রবিন্দুর অভাব:
অ্যাপলের গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) বরাবরই প্রাইভেসি ও সিকিউরিটি ভিত্তিক ছিল। অন্যদিকে গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ডেটা এবং ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভর করে দ্রুত এআই ফিচারগুলো তৈরি করেছে। অ্যাপল প্রাইভেসি নীতিতে কড়াকড়ি থাকায় তারা এতদিন বড় মাপের ডেটা ব্যবহার করতে পারেনি, যা এআই প্রযুক্তির বিকাশে একটি মূল চ্যালেঞ্জ।
৪. প্রতিযোগীদের দ্রুত উদ্ভাবনী ক্ষমতা:
অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, এবং গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এআই-এর ক্ষেত্রে অনেক নতুন উদ্ভাবন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের ডিপমাইন্ড এবং মাইক্রোসফটের ওপেনএআই অংশীদারিত্বে চ্যাটজিপিটি এরকম প্রযুক্তিগুলো খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিযোগিতার এই তীব্র গতিতে অ্যাপল কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে, কারণ তারা এই ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম গতিতে কাজ করেছে।
৫. সিরি’র সীমাবদ্ধতা:
অ্যাপলের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরি প্রথম এআই ভিত্তিক ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টগুলোর একটি ছিল, তবে আজকের মাপকাঠিতে সিরি পিছিয়ে পড়েছে। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং অ্যামাজনের অ্যালেক্সা এখন এআই এবং মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে আরও উন্নত সেবা দিচ্ছে, যা সিরি এখনও সরবরাহ করতে সক্ষম হয়নি।
৬. তৃতীয় পক্ষের ওপেন ওয়েব ডেটার ব্যবহার কম:
অ্যাপল অন্যান্য এআই সিস্টেমের মতো ওপেন ওয়েব থেকে বিশাল পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করে না। যেখানে ওপেনএআই এবং গুগল তাদের মডেল ট্রেন করতে ওয়েব থেকে ব্যাপক ডেটা সংগ্রহ করে, অ্যাপল তাদের প্রাইভেসি নীতি বজায় রাখতে কাস্টমাইজড ডেটার উপর নির্ভরশীল, যা তাদের এআই উন্নয়নের গতি কমিয়ে দেয়।
এআই-এর সঙ্গে অ্যাপলের অন্যান্য পণ্যের সংযোগ
টিম কুকের মতে, অ্যাপল তাদের পণ্যে এমন কিছু আপডেট নিয়ে আসবে যা তাদের প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করবে। এরমধ্যে, অ্যাপলের বিভিন্ন পণ্য যেমন আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক, এবং অ্যাপল ওয়াচেও এআই ফিচার যুক্ত করা হবে। প্রত্যেকটি ডিভাইসের জন্য আলাদা আলাদা এআই ফিচার উন্নয়ন করা হচ্ছে, যা ডিভাইসগুলোকে আরও স্মার্ট এবং কার্যকর করে তুলবে।
এছাড়াও, অ্যাপল তাদের এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে হেলথকেয়ার এবং ফিটনেসের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা আনতে কাজ করছে। অ্যাপলের ডিভাইসগুলো ইতোমধ্যেই হেলথকেয়ার সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে, এই ভূমিকা আরও সম্প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য
টিম কুকের বক্তব্য অনুসারে, অ্যাপল সবসময় ব্যবহারকারীদের সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। তাই ভবিষ্যতে তাদের এআই ফিচারগুলো আরও পরিপূর্ণ এবং কার্যকর হবে। অ্যাপল বিশ্বাস করে, এআই সেবার প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে হলে শুধু দ্রুততা নয়, বরং গুণগত মানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর সেজন্য তারা ধীরে এগোলেও, তাদের সেবা হবে সর্বাধিক কার্যকর।
চূড়ান্ত ভাবনা
এআই প্রযুক্তির বাজারে অ্যাপলের প্রবেশ কিছুটা দেরিতে হলেও, তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট। টিম কুকের বক্তব্য অনুসারে, অ্যাপল সবসময় সেরা হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ব্যবহারকারীর প্রাইভেসি, অভিজ্ঞতা এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অ্যাপল তাদের এআই প্রযুক্তি তৈরি করছে। ভবিষ্যতে অ্যাপলের এআই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করবে, সেটি বলা যেতেই পারে।
এখন দেখার বিষয়, অ্যাপল তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী “সেরা” এআই সেবা দিয়ে প্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতায় কতটা সফল হতে পারে।